Monday 18 July 2016

ইসলামিক স্টেট, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান



ইসলামিক স্টেট, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান
ইসলামিক স্টেট, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান
ইসলামিক স্টেট, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান


ঠিক যেভাবে, যে গতিতে তালেবানরা পাকিস্তান থেকে বের হয়ে আফগানিস্তান দখল করেছিল, অনেকটা সেভাবেই আই.এস.আই.এল (আইসিল) সিরিয়া থেকে বের হয়ে ইরাক দখল করেছেসামরিক প্রশিক্ষণ, শক্তি ও সরঞ্জাম বিবেচনা করলে দুটোর মধ্যে অনেক মিল লক্ষণীয়পার্থক্য যে নেই তা নয়তালেবানরা রাজধানী কাবুলেই তাদের সরকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল, আফগানিস্তান নামক স্বীকৃত রাষ্ট্রের শাসক হয়েছিল অন্যদিকে আইসিল দুটি রাষ্ট্রের বিরাট অংশ কব্জায় নিতে পারলেও কোনো দেশের রাজধানী অবধি তারা পৌঁছতে পারেনিসিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক এখনও আসাদের কব্জায় এবং ইরাকের বাগদাদ এখনও ইরাক সরকারের অধীনেই রয়েছেজাতিসংঘসহ সকল দেশের কাছে এখনও আসাদ সরকার ও বাগদাদ সরকারই যথাক্রমে সিরিয়া ও ইরাক সরকার আইসিলের দখল করা জায়গায় যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা বিশ্বের কাছে একটি লুণ্ঠন করা ভূমি হিসেবে পরিগণিত হয়ে আছেকিন্তু সমস্যা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ডাকাতি হয়ে যাওয়া ভূমি কিভাবে উদ্ধার করা যায় তা নিয়ে

উদ্ধারের কথা এলে আসে উদ্ধার করবে কেআর উদ্ধার করা জমি দেয়া হবে কাকে”—প্রশ্ন দুটিখোদ এই অনিবার্য প্রশ্ন দুটির উত্তর বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ঘোলাটে হয়ে উঠেছেউদ্ধারকর্মে পশ্চিমাদের আগ্রহ এ মুহূর্তে খুব একটা দেখা যাচ্ছে নাতারা এখানে ওখানে বোমা ফেলছে আর আগাম ঘোষণা দিয়ে বিশ্ববাসীকে জানান দিচ্ছে যে, এতে আপাতত তেমন কাজ হবে না; এটা একটা দীর্ঘ মেয়াদি যুদ্ধ ইত্যাদিকোবানি আক্রমণে আইসিলের সেনা মোতায়েন ও রিইনফোর্সমেন্ট নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হয়েছে, আইসিলের উপর বোমাও পড়ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যথারীতি আমাদেরকে শুনতেও হচ্ছে যে, কোবানির পতন ঠেকানো যাচ্ছে নাযুক্তরাষ্ট্র আসাদকে জমি উদ্ধারের দায়িত্ব দিতে যেমন নারাজ, তেমনই নারাজ ইরাকের শিয়াদেরকে দিতেওকাজেই নিজেরা তা উদ্ধার করে আসাদ বা শিয়াদেরকে দেবে কোন কারণে? ফলে আপাতত কিছুদিন আইসিল কিছু সুবিধায় থাকছে বলেই অনুমান করা যায়

এখানে করিৎকর্মা সি.আই.এ-এর আরেক দক্ষতার সাথে আমাদের পরিচয় ঘটেছে সাদ্দামের ইরাকের বেলায় সি.আই.এ যা নেই তা দেখতে পেয়েছিলসাদ্দামের গুদামেমওজুদবিশাল আয়তনের গণবিধ্বংসী অস্ত্রশস্ত্রএবার আইসিলের মতো বাহিনী গড়ে উঠলো সিরিয়ায়, আমেরিকা-ইউরোপ থেকে পর্যন্ত লোক-লস্কর এসে জুড়লো সেখানে, এতো এতো ভারী ভারী যুদ্ধযান সব আমদানি হলো, কাড়ি কাড়ি টাকা উড়ে আসলোকিন্তু সি.আই.এ এতো থাকা কিছুর কিছুই দেখতে পেল নামার্কিনীরা আগের বার বলেছিল, “ওহহো, বেটা সি.আই.এ ভুত না দেখলে তো যুদ্ধটারই দরকার হতো নাএবার বলছে, “ওহহো, বেটা সি.আই.এ দৈত্যের বাচ্চাটাকে সময়মত দেখলে তো আজ সেটা এতো বড় হওয়ার সুযোগ পেতো না

ইরানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বেকায়দায় আছে সেই খোমেনির তেহরানে প্রত্যাবর্তনের দিন থেকেইকূটনীতিতে একের পর এক পরাজয় নিয়ে ঘরে ফিরতে হয়ে থাকে যদি কোনো পরাশক্তির, তবে তা ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ঘটেই জুটেছেযুক্তরাষ্ট্র ইরানের ডানে-বায়ে আফগানিস্তান ও ইরাকে শক্তভাবে অবস্থান নিতে চেয়েছিলকিন্তু ইরানের সদর অন্দর দুই দরজা পর্যন্ত যেতে যেতেই সে ক্লান্ত হয়ে পড়লোউল্টো ইরান পেল সাদ্দামের এক কাড়ি জঙ্গি বিমান আর শাতিল আরবতারপর ইরাকে প্রতিষ্ঠিত হলো ইরানের প্রভাব, খোদ যুক্তরাষ্ট্রের অবদান হিসেবেইআহারে! একসময় এই ইরাককেই যুদ্ধে নামিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধেতখনকার নতুন তেহরান সরকার এই যুদ্ধকে আশ্রয় করেই গড়ে তুললো জাতীয় ঐক্য, খোমেনি আরও জাঁকিয়ে বসলোআইসিলের খবর আমরা তখনও জানি না, ইরানী নেতা ভবিষ্যতবাণী করলেন, বিশ্ববাসী সিরিয়ার মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় দেখতে পাবেআসাদের পাশে দাঁড়িয়েছে ইরান আর রাশিয়া আমরাও দেখলাম প্রথম রাউন্ডে যুক্তরাষ্ট্র বলতে গেলে হেরেই গিয়েছেরাশিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্র এখন বেজায় নাখোশআসাদ, ইরান ও রাশিয়াকে এক সাথে এক হাত দেখে নেয়ার এখন ভাল হাতিয়ার আইসিল

যুক্তরাষ্ট্র ও আইসিলের মধ্যকার বর্তমান সাপে-নেউলে সম্পর্কের কতটুকু খাঁটি আর কতটুকু পাতানো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠানো যায় যুক্তরাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ধরণ থেকেতবে একথাও বলা যায় যে, আইসিলের সাথে আপাতত সুবিধায় থাকছে যুক্তরাষ্ট্রওযুক্তরাষ্ট্রের অন্য দুটো গুরুত্বপূর্ণ সুবিধার একটি হচ্ছে আরবদেরকে দিয়ে আরবে যুদ্ধ করা ও অপরটি পশ্চিম থেকে উগ্র সালাফীদেরকে আরবে এনে ফেলাএবার আমরা পশ্চিমা গণমাধ্যমে নতুন টার্মিনোলজির ব্যবহার দেখতে পাচ্ছিটেররিস্ট শব্দের ব্যবহার কিছুটা কমেছে, আইসিলকে পরিচিত করানো হচ্ছে জিহাদিষ্ট হিসেবেকুর্দিদের পিকেকে, সিরিয়ার নুসরাহরা সকলেই টেররিস্টনুসরাহরা আলকায়দাও বটেকিন্তু আসাদের বিরুদ্ধে তারা লড়ছে, তারা আবার আইসিল বিরোধীওবিপরীত ফ্রন্টে আইসিলের বিরুদ্ধে আছে পিকেকেওবিভাজন ও বিরোধ এসেছে শিয়া-সুন্নিদের মধ্যেআরেক বিরোধকে বলা হচ্ছে কুর্দি-সুন্নি বিরোধশিয়া-সুন্নি বিরোধ আমাদের কাছে বোধগম্য হলেওকুর্দি-সুন্নিটার্মিনোলজি খুবই কৌতূহলের বিষয়, কারণ কুর্দিরাও সুন্নি অন্যদিকে, শিয়া-সুন্নি বিরোধ তাত্ত্বিক দিক থেকে তত বৈরী নয়আসল ভয়ংকর তাত্ত্বিক বিরোধটা হচ্ছে সালাফী-শিয়া বিরোধজিহাদিস্টরা সালাফীদের মধ্যকার একটি উপদলসালাফীরা এক অর্থে সুন্নি হলেও ঐতিহ্যগত মাজহাবী সুন্নি, বিশেষ করে হাম্বলীরা বাদে অন্য তিন উসুলী (সার্বিক সূত্র/নীতি আশ্রয়ী) সুন্নি মাজহাব থেকে র‍্যাডিক্যালী ভিন্নএরা যেখানে যাবে সেখানে শিয়ারা সমানে নিহত হবে, নিহত হবে তাদের বিরোধিতাকারী কুর্দি ও সুন্নিরাওআবার যখন জিহাদিস্টরা হেরে যাবে তখন সুন্নিরা সমানে নিহত হবে শিয়াদের হাতে, অ-কুর্দি আরবরা নিহত হবে কুর্দিদের হাতেএর মাঝে বর্তমানে হাজারে হাজার কুর্দি উদ্বাস্তু হচ্ছে, হচ্ছে শরণার্থী; যাদের নিয়ে কারও তেমন কোনো মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না

কাজেই দেখা যাচ্ছে, আরবদের নিজেদের বিরোধকে এমনভাবে বহুমাত্রিক করা সম্ভব হয়েছে যে, তা প্রকাশ করার যথাযথ শব্দেরও আকাল পড়ে গিয়েছেসমস্যা রপ্তানি করা গেছে আরেক জাতি তুর্কিদের মধ্যেওইতোমধ্যে সেখানে পুলিশের গুলিতে মারা যাচ্ছে কুর্দিরাট্যাংক নিয়ে লাইন ধরে তুর্কিরা উঁচু ভূমিতে বসে পশ্চিমাদের বোমারু বিমান আর আইসিলের গোলায় তৈরি হওয়া ধুঁয়ার কুণ্ডলী দেখে সময় কাটাচ্ছেনীচে আইসিল দিনে দিনে কোবানি দখলে এগুচ্ছেজাতিসংঘ আর পশ্চিমারা চাপ দিলেও তুরস্ক নিজের যোদ্ধাদেরকে এক শত্রুর পক্ষে গিয়ে আরেক শত্রুর গোলার বলী হতে দিতে সহজে রাজী হবে নাতুরস্কের মুখ থেকে তাই আসল মার্কিন ইচ্ছাটাই ছুতা হিসেবে বের হয়ে এসেছেতুরস্কের পরিষ্কার কথা, “সবকিছুর মূল কারণআসাদকে আগে হটাতে হবে, তারপরে কোবানি নিয়ে ভাবা হলে তখন দেখা যাবে কী করা যায়এদিকে সন্ত্রাসীপিকেকে-নুসরাহ ও দুনিয়ার সব মুক্তি সংগ্রামে মহান অংশীদারযুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভাই-ভাই ভাব দেখা ছাড়াও আমাদেরকে শুনতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সহযোগিতার কথাওইরান নিজের গুরুত্ব বাড়িয়েছে; তার পারমানবিক বোমা তৈরির কাজ ভেস্তে দেয়ার মার্কিন পরিকল্পনাও আপাতত লাটে উঠেছেওদিকে ইসরাইল আসল শত্রুকে চিনতে এখনও ভুলের মধ্যে পড়েনিতারস্বরে বলে চলেছে, আইসিল নয়, ইরানই তার জন্য আসল হুমকি
আইসিল নাটক এবং আইসিল চাল যুক্তরাষ্ট্রকে আখেরে আরেকটি লাভ বয়ে এনে দিতে পারেতা হচ্ছে আরব জনগণের কাছে ত্রাণকর্তা দেবতার আসনসৌদি আরবের রাজার মতো আরব রাজাদের এবং মিশর-আলজেরিয়ার প্রাহসনিক গণতন্ত্রী শাসকদের কাছে যুক্তরাষ্ট্র দেবতার মতো হয়ে থাকলেও আরব জনগণের কাছে তার ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছেএতদিন ধরে সাধারণ আরবরা যুক্তরাষ্ট্রকে সব নষ্টামির নাটের গুরু হিসেবে দেখে আসছেসেই সময় হয়তো দ্রুত এগিয়ে আসছে যখন গণ আরবরা যুক্তরাষ্ট্রের পায়ে পড়ে বলবে, এবার সৈন্য নিয়ে এসো ভাই, আমরা যে আর পারছিনেমোট কথা, আইসিল যুক্তরাষ্ট্রের এমন এক গুটি যা দিয়ে সে এক ঢিলে অনেক পাখি শিকার করতে যাচ্ছে হয়তো

যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষা নিতে ভুল করে নাসে ভিয়েতনাম থেকে শিক্ষা নিয়ে আফগানিস্তানে গিয়েছেসেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে গিয়েছে ইরাকেএবার সব শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে উত্থিত করেছে আইসিলকেমিশরকে সে আগেই সাইজ করেছে সেনাবাহিনীকে নতুন রূপে এমন ভাবে এনেছে যে, আগামী বিশ-পঁচিশ বছরের জন্য বসন্ত বাতাসে উত্তাল মুক্তিকামীদেরকে এই সেনাবাহিনী এবং তাদের দেয়া গণতন্ত্র নিয়েই তুষ্ট থাকতে হবে; আল-বারাদেকে আর দেখাও যাবে না, তার কথাও শোনা যাবে নামোটাবুদ্ধি গোঁয়ার-গোবিন্দদের দল ব্রাদারহুড গরাদের এপার ওপার দুপারেই ঠাণ্ডা হয়ে বসে থাকবেকিন্তু সিরিয়ায় ও ইরাকে ইরানের কাছে হেরে যাওয়ার বদলা যুক্তরাষ্ট্র নেবে কিভাবে তা-ই এখন দেখার বিষয়কারণ আইসিলকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র যেমন নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইবে, তেমনই আইসিলও যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে তার এজেন্ডা নিয়ে জয়ী হতে চাইবেআইসিলকে বাইরের কেউ স্বীকার করুক আর না-ই করুক তারা সুবিশাল জমি দখলে নিয়েছে, সে জমির সুন্নিদের কাছে তারা গৃহীত হয়েছেএটা আফগানিস্তানের পাহাড় নয় যে ক্লাস্টার বোমা ফেলা যাবেসুন্নি নিধন ছাড়াই জিহাদিস্ট-সালাফী আইসিলকে পরাজিত করার শেষ সর্বাত্মক লড়াই কিভাবে সম্ভব, যেখানে আবার সিরিয়ার মাটিতে আসাদেরও হার হবে, ইরাকের মাটিতে ইরানেরও হার হবেপশ্চিমাদের কাছে এখন সেটাই খুঁজে বের করার বিষয়তবে যুদ্ধ এড়াতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র, আকাশ থেকে হলেও বোমা ফেলতে হবেএটাও ঠিকচীনারা পশ্চিমাদের এই অবস্থাকে দেখছে আমোদের সাথেইআরবরা নিপতিত থাকছে নানা কিসিমের যুদ্ধের মাঠে আর শরণার্থী শিবিরে

No comments:

Mobile

Pages