জঙ্গি হতে স্বপরিবারে দেশ ছারলেন একজন চিকিৎসক
সময়ের কণ্ঠস্বর ডেস্ক – ‘ভাই, আল্লাহর রাস্তায় চলে যাচ্ছি। দোআ করিও। পরকালে তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে’—স্বজনদের সঙ্গে এসব কথা বলেই বছর খানেক আগে স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক মেয়ের জামাতাসহ দেশ ছেড়েছিলেন এক চিকিত্সক। সূত্রমতে, তারা প্রথমে বাংলাদেশ থেকে যান মালয়েশিয়ায়, পরে সেখান থেকে তারা পাড়ি জমান তুরস্কে। জঙ্গি কার্যক্রমে অংশ নিতেই তাদের এই বিদেশ যাত্রা। প্রসঙ্গত, এই চিকিত্সকের এক মেয়ে ও তার স্বামী দুজনেই নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ছিলেন।
সপরিবারে বিদেশ পাড়ি দেওয়া এই চিকিত্সকের নাম রোকনুদ্দীন খন্দকার। ঢাকা শিশু হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. রুহুল আমীনের অধীন রেজিস্ট্রার ছিলেন তিনি। যাওয়ার আগে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন।
একজন চিকিত্সকের সপরিবারে জঙ্গি কার্যক্রমে যোগ দেয়ার বিষয়টি এক বছর পর ফাঁস হলে ঢাকা শিশু হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিত্সকরা বিস্মিত হয়ে যান। তারা বলছেন, তারা কল্পনাও করতে পারছেন না যে তার মতো একজন চিকিত্সক জঙ্গি কার্যক্রমে অংশ নিতে দেশ ছেড়েছেন। তারা জানান, শিশু হাসপাতালে চাকরি করা কালে তার মধ্যে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার ছাপ দেখা যায়নি।
রাজধানীর খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার ৪৪১/বি নম্বর বাড়িতে সপরিবারে থাকতেন ডা. রোকনুদ্দীন খন্দকার। তার স্ত্রী নাইমা আক্তার মালিবাগের হোমিও চিকিত্সক ডা. আলী আহম্মেদের মেয়ে। পৈত্রিক সূত্রে মালিবাগের ওই বাড়ির মালিক নাইমা আক্তার ও তার ছোট বোন ডা. হালিমা আক্তার। সাত তলা বাড়ির ১৪টি ফ্ল্যাটের মধ্যে দুই বোন ৭টি করে ফ্ল্যাটের মালিক। এই বাড়ির তৃতীয় তলার ডান পাশের ফ্ল্যাটে থাকতেন ডা. রোকনুদ্দীন খন্দকার। তার বড় মেয়ে রেজওয়ানা রোকন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। ওই বিভাগের শিক্ষার্থী শিশিরের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
গত বছরের জুনে একদিন হঠাত্ করে তারা সপরিবারে বিদেশ যেতে রওনা দেন। বিদায় বেলায় পরিবারের সদস্যদের কাছে রোকনুদ্দীন বলেন, ‘ভাই, আল্লাহর রাস্তায় চলে যাচ্ছি। দোআ করিও। পরকালে তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে।’
গতকাল মালিবাগের ওই বাড়িতে কথা হয় নাইমা আক্তারের ছোট বোন ডা. হালিমা আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত বছর রোজার সময়ে হঠাত্ একদিন তার বোন তাকে জানান যে সপরিবারে তারা বিদেশ যাবেন। এর ২-৩ দিন পর একদিন সন্ধ্যায় তাকে জানান যে ওইদিন রাত ২টায় তাদের বিদেশ যাওয়ার ফ্লাইট। প্রথমে তারা মালয়েশিয়া যাবেন। এরপর সেখান থেকে তুরস্কের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন। তার স্বামী রোকনুদ্দীন খন্দকার সেখানে একটি হাসপাতালে চাকরি পেয়েছেন।
হালিমা আহমেদ আরো বলেন, রোকনুদ্দীনের সঙ্গে তার স্ত্রী, দুই সন্তান রেজওয়ানা রোকন ও রামিতা রোকন, রেজওয়ানা রোকনের স্বামী সাদ কায়েস রওনা দেন। এরপর থেকে তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। রোকন উদ্দিনের বড় ভাই আফাজ উদ্দিনের ছেলেমেয়েরা এখন সাতটি ফ্ল্যাট দেখাশোনা করছে। হালিমা আহমেদ বলেন, সদ্য সমাপ্ত রমজান মাসে হঠাত্ একদিন একটি বিদেশি নম্বর থেকে তার কাছে মোবাইল ফোনে কল আসে। ওপার প্রান্ত থেকে নাইমা আহমেদ জানান যে তারা তুরস্কে আছেন, ভালো আছেন। এর বেশি কথা হয়নি।
এক পরিবারের পাঁচজন এক বছর ধরে নিখোঁজ থাকার বিষয়টি তদন্ত করতে গত বৃহস্পতিবার রামপুরা থানা পুলিশের একটি টিম মালিবাগের ওই বাড়িতে যায়। পুলিশ তদন্ত শেষে নিশ্চিত হয় যে তারা বাংলাদেশে নেই।
তদন্ত শেষে শনিবার রাতে রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম ওই থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। ওসি রফিকুল ইসলাম নিখোঁজ ওই চিকিত্সকের ভাই আফাজ উদ্দিনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ভাই দেশে না ফেরায় ওইসব ফ্ল্যাটের ভাড়া বড় ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা জমা করছেন। তবে কী কারণে তার ভাই দেশে ফিরছেন না বা তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ হয়েছিল কিনা-এ ব্যাপারে পুলিশকে আফাজ উদ্দিন বিস্তারিত তথ্য দেননি। ওসি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত থাকার বিষয়টি রহস্যজনক। এর সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। বিষয়টি পুলিশের শীর্ষ পর্যায়কে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।
শেরে বাংলা নগরে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন বলেন, অনেক আগে ডা. রোকনুদ্দীন ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। তবে তিনি মৌখিকভাবে তার কাছে জানিয়েছিলেন, ‘তিনি অস্ট্রেলিয়ায় ইমিগ্র্যান্ট হয়েছেন। হঠাত্ তার মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায়। লম্বা দাড়ি রেখে চুপচাপ থাকেন। হঠাত্ চাকরি থেকে বিদায় নেয়ার বিষয়টি কর্তৃপক্ষের কাছে রহস্যজনক মনে হয়েছে।
অন্যদিকে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আরো দুই জন নিখোঁজ থাকার ব্যাপারে জানতে পেরেছে। এরা হলেন বনানীর ডা. আফজাল হোসেনের ছেলে তাওসীফ হোসেন। নিখোঁজ তাওসীফ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। পুলিশ জানিয়েছে, তিনি দেশেই অবস্থান করছেন। দেশের একটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা মিলেছে।
অপর নিখোঁজ ব্যক্তি হলেন সেজাদ রউফ ওরফে অর্ক ওরফে মরক্কো। তার পিতার নাম তৌহিদ রউফ। বারিধারায় তার বাসা। তিনিও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায় নিখোঁজ ১০ জনের এখনও সন্ধান মিলেনি। তাদের পরিবারের সদস্যরা সন্তানদের ফিরে আসার আকুতি জানিয়েছেন। তারা অপেক্ষা করছেন যে কখন তাদের সন্তান ফিরে আসবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম শাখার একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের অনেকেই জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে আত্মগোপন করে আছে।